ফ্রিল্যান্সিং শুরুর আগে জানতে হবে এই সাতটা বিষয় যার ওপর নির্ভর করবে আপনার সফলতা কিংবা ব্যর্থতা।

  • সিরিয়াস না হওয়া
  • বাজে উপস্থাপনা
  • গবেষণার অভাব
  • মানসিক প্রস্তুতি না থাকা
  • নতুন থাকার মানসিকতা
  • ধৈর্য না থাকা
  • না জেনে না বুঝে ফ্রিল্যান্সিং করতে আসা

১) সিরিয়াস না হওয়া

আমরা সব সময় বলি, দক্ষ হন, মন দিয়ে কাজ করুন। আগে শিখুন পরে মার্কেটে আসুন তাহলে কাজ পাবেন। কিন্তু এর বাইরেও এমন কিছু ব্যাপার আছে যেগুলি যদি মেনে না চলতে পারেন, তাহলে অনলাইন এ টাকা উপার্জন তো দূর, অনলাইন দুনিয়াটাই আপনার জন্য নয়।

আমাদের আজকের দিনের অনেকেই অনলাইন জগতে প্রবেশ করছেন অনেকটা ধুম করেই আর তার বেইজ হচ্ছে টাকা কামানো। কিন্তু এর সাথে প্রাসঙ্গিক ব্যপার স্যাপার গুলি মেইন্টেইন করার চিন্তাভাবনা কারোর মধ্যেই নেই! এই বিষয়টাকে আমরা তুলনা করতে পারি এভাবে, ক্লাস এইট এর একটা বাচ্চা হঠাৎ কারো কাছে শুনল বিসিএস পরিক্ষা দিলে নাকি বিশাল বড় সরকারী চাকরী পাওয়া যায়, আর শুনেই সে কাছের বইয়ের দোকান থেকে একটা বিসিএস এর গাইড এনে পড়া শুরু করে দিলো আগামি বছর বিসিএস দেবে এই আশায়। এখানে বাচ্চার সাধারণ জ্ঞ্যান এর বিকাশ ঘটলেও ধুম ধাম ফ্রিল্যান্সিং এ এলে আপনার শুধু হতাশার বিকাশ ই ঘটবে আর কিচ্ছু হবে না।

তো, কাজের প্রতি সিরিয়াসনেস কাজের জন্য ভীষণ ডেডিকেটেড একটা পার্ট। কমিউনিটি গুলিতে দেখা যায় অনেকেই পোস্ট করেন,

  • বায়ার অর্ডার করেছে দুইদিন হল, আমি ঘুমায় ছিলাম, দেখতে পাইনি। এখন ডেলিভারি টাইম পার হয়ে গেছে। এখন কি করবো?

  • বায়ার নক দিয়েছিল পাঁচ দিন আগে, আমি তখন ও, ইভেন এই পাঁচ দিন ই ঘুমায় ছিলাম। এখন কি তাকে রিপ্লে দিবো? রেস্পন্স রেট কমে গেছে। কি করতে পারি?

  • একটা কাজ বায়ার রিভিশন চেয়েছে কিন্তু আমি দেখিনি। তখন আমি কি করছিলাম তা সবাই জানেন। সো, এখন আমি কি করবো?

  • এক বায়ার অর্ডার ক্যান্সেল করেছে। আমি খেয়াল করিনি কারণ তখনও আমি… সো এখন আমার ক্যান্সেলেশান রেট বেড়ে গেছে। কি করনীয়?

এমন আরও অনেক কথা আছে যখন আপনারা ঘুমে থাকেন, আপনাদের হুস থাকে না। (কথা টা মজা করে বলেছি। অনেকের অনেক বিপদ আপদ আসে, আল্লাহ তাদের হিফাজত করুন, কিন্তু মুল কথা টা কিন্তু এটাই। সিরিয়াস না হওয়া।

ওপরের চারটা কেস স্টাডি করলে বুঝবেন, শুধু মাত্র কেউ কাজে সিরিয়াস না হওয়ার কারণেই এসব অঘটন কিন্তু ঘটছে। আপনি একটা কাজ করবেন তার ডেডলাইন কেন আপনার টুডু লিস্ট এ এন্ট্রি করা থাকবে না? যেই মারকেটে কাজ করে আপনি হাজার হাজার ডলার ইঙ্কামের স্বপ্ন দেখেন, সেইখানে সোনার হরিণ (বায়ার) নক দিলে আপনি কই থাকেন যে তিন দিনেও আপনি সেই মেসেজ সিন করেন না? যদি এটাই আপনার মুল কাজ হয়ে থাকে, সারাদিন ফোন, ল্যাপ্টপ আর পিসি গুতিয়ে আপনার সময় কাটে, তাহলে কেনই বা রিভিশান দিলে সেটা ঠিক সময়ে করে দিতে পারেন না? আর টাইম বেশি লাগলে সেটা কেনই বা বায়ার কে বুঝিয়ে বলে সময় বাড়িয়ে নিচ্ছেন না?

এই গুলি আর কিচ্ছু না, সিন্সিয়ারিটির অভাব। এর কারণ হতে পারে আপনি হয়তো এগুলি কনদিন ই মেইন্টেইন করেন নি! যেমন যে ছেলে বা মেয়ে টা সারাদিন মা এর রান্না খেয়ে এসেছে, শহরে পড়তে এসে মেসে হথাৎ একদিন বুয়া না এলে সে তো আর নান্নার বিরিয়ানি রান্না করে ফেলতে পারবে না! আমাদের অধিকাংশর অবস্থা এই। আমরা হয়তো এটাকে ক্যারিয়ার হিসেবে নিয়েছি ঠিকি, কিন্তু আমরা এর জন্য তৈরি না। এর পারিপার্শ্বিকতার সাথে আমরা নিজেদের মেলাতে পারছিনা।

তবে এটা যে পারছিনা, সেটা আপাতত বুঝলেই হবে আর চেষ্টা করে যেতে হবে এর সাথে নিজের জীবনটা খাপ খাইয়ে নেয়ার। অনলাইন ফ্রিল্যান্সারদের লাইফ স্টাইল আর বাকি সাধারণ মানুষের সাথে মেলে না। এমন কি আমাদের নিজেদের সাথেই নিজেদের লাইফস্টাইল মেলে না! কাজেই আপনাকে আপনার টা বেছে কিংবা খুজে নিতে হবে কাজের ধরন ও চাহিদা অনুযায়ী! 

সুতরাং ডেডিকেটেড হন। কাজের প্রতি সিরিয়াস ও যত্নশীল হন। তবেই মিলবে কাজ। অন্তত নিজেকে কাজের জন্য উপযুক্ত করে গড়ে তো তুলতে পারবেন! আর এটাই সবার আগে দরকার।

২। বাজে উপস্থাপনা

সিরিজের দ্বিতীয় পর্বে আপনাদের স্বাগতম। তো আমরা কথা বলছিলাম অনলাইনে স্কীলস বাদেও যে ব্যাপার গুলি ভীষণ দরকারি বা যেগুলির ওপর বিশেষ ভাবে মনোনিবেশ করা দরকার যা কিনা কিছু ক্ষেত্রে দক্ষতার থেকেও অনেক বেশি দরকারি সেই সব বিষয় নিয়ে! এই সিরিজের কন্টেন্ট গুলি বিশেষ কাজে দেবে যারা নতুন শুরু করেছেন, কিংবা মার্কেটে এসে অথৈ জলে হাবু ডুবু খাচ্ছেন কিংবা চাইছেন অনলাইনে ক্যারিয়ার গড়তে। তো আজকে আমরা কথা বলবো উপস্থাপনা নিয়ে জেটাকে ইংরেজিতে আমরা বলতে পারি প্রেজেন্টেশেন। 

এক কালে এই শব্দটা স্কুল কলেজ ইভেন ইউনিভার্সিটির জীবনেও ছিল এক ত্রাস কিংবা বিরক্তির আরেক নাম। ৫-১০ মার্কস এর এই প্রেসেন্টেশান এর জন্য না জানি কতো কাঠ খড়ি পোড়াতে হয়েছে তখন। আসলে সেই সময় যদি বুঝতাম এর গুরুত্ব খানা, তখন এটা খুব ভালো করে মাথায় ঢুকিয়ে রাখতাম। কিন্তু হায়, তখন তো কেউ ছিলনা এগুলি বলার মতো। 

সো এখন প্রশ্ন হল, অনলাইনে এই প্রেসেন্টেশান কেমনে আসলো যেখানে সব ভার্চুয়াল লেনা দেনার খেল? এমন কি ক্লায়েন্ট এর সাথে তো কথাও হয়না। তাহলে ভাই এটা কিসের মন্ত্র? হুম, ভালো প্রশ্ন। আসলে প্রেসেন্টেশান টা হচ্ছে একটা মানুষের আউটফিট। সাথে তার সাজ সজ্জা, গহনা, মুখের বুলি, মাথার মুকুট তার মানে বলতে পারেন আজ আপনি আমাকে যা ভাবেন, কিংবা আমি আপনাকে যা ভাবি এর মুল কারণ ই এই আমাদের দুজনের প্রেসেন্টেশান।

বউ পেটানো লোক টাও হতে পারে কলেজের সেরা লেকচারার। কিংবা সাধারণ কলেজের টিং টিঙ্গে খোর ছেলেটাও হয়তো বুয়েটের অনেক ভাইয়ার থেকেও অনেক ভালো পড়ায়। কারণ কি? দুইটা, আপনি কি বুঝলেন, আর তা আপনি কিভাবে উপস্থাপন করলেন।

এবার আসি ফাইভারে বা অনলাইন মার্কেটে গুলিতে। এখানে প্রতিটি পদক্ষেপ ই প্রেসেন্টেশানের অংশ। এখানে শুরুতেই আপনাকে আপনার প্রফাইল সাজাতে হয় আর যা দেখেই প্রথমে কোন ক্লায়েন্ট হয়তো ইম্প্রেস হবেন। তার পরে আসে সার্ভিস সাজানো, দেন, কভার লেটার বা বায়ার রিকু দেয়া। কেউ নক করলে তার উত্তর দেয়া। কাজ চলা কালিন সময় কি বলছেন, কি করছেন, কিভাবে করছেন আর সেই সাথে তাকে পারমানেন্ট বায়ার হিসেবে বাগিয়ে নেয়ার যে ফন্দি ফিকির, সবি তো ভাই প্রেসেন্টেশান এর ভেল্কী। এটা যত ভালো পারবেন, আপনার প্রগ্রেস অনলাইনে ততই সুগম হবে!

মনে রাখবেন একটা বাজে জিনিস ও শুধু মাত্র ভালো প্রেসেন্টেশানের কারণে মার্কেটে চলে যায়। তা না হলে গ্রামের দাদু কয়লায় দাঁত মেজে খ্যাত হলে আমাদের আধুনিক সমাজের টুথপেস্ট এ কয়লা ঢুকাল কেন? এটা তো খ্যাত না? বরং আপনার পেস্ট এ কয়লা, লবন, হলুদ, মরিচ না থাকলেই আপনি খ্যাত। তাহলেই বুঝুন! আপনাকে কোন কাজে আসলেই ১০ বছরের অভিজ্ঞ থাকতে হবে না, না আপনাকে প্রভাইড করতে হবে ওয়ার্ড ক্লাস সেরা সার্ভিস। আপনি টুক টাক যা করেন সেটার সেরাটাই দেয়ার প্রয়াস করুন, কিন্তু তার উপস্থাপনা টা হওয়া চাই সেরা!

৩। গবেষণার অভাব

ফ্রিল্যান্সিং আসলে গুটি কয়েক ভিডিও দেখে, এখানে ওখানে বর্ণালী ছবি টবি পোস্ট করে বিদেশি বায়ার থেকে এই পাঁচ দশ ডলার বাগিয়ে নেয়াকে বলেনা কোন ভাবেই। আপনি আজ শুরু করলেও এটা একটা এন্ডলেস বিজনেস যেখানে আপনাকে প্রতিটা ঘন্টা থাকতে হবে প্রফেশনাল শুধু তাই না, আপনার চিন্তা চেতনার মধ্যেও আনতে হবে প্রফেশনালিজম।

আশা করি সবাই জব এবং বিজনেস এর মধ্যে মুল তফাৎ গুলি জানেন। অন্তত এটুকু তো দেখেছেন যে যেকোন ব্যবসায় কেউ গেলে অন্তত আগে ৫-১০ বছর জব করে তার পরে যে নিজের কিছু শুরু করছে যেখানে আমরা ফ্রিল্যান্সাররা ২ দিনের কোর্স করে মুখ উঠিয়ে চলে আসছি এই বিজনেসে আর এখানে ব্যবসার স্ট্রাটেজিক ৯০% জিনিস ই অজানা যা কিনা আমাদের অধিকাংশ এখানে ওখানে ব্যঙ্গের ছাতার মতো গড়ে ওঠা কোচিং সেন্টার গুলিতে শেখানো হয়না কোন দিনি কারণ এটা এক দিনে শেখার ব্যপার নয়।

তো বুঝতেই পারছেন, ফ্রিল্যান্সিং এ হয়তো আপনি এখন টুক টাক ইমেজ এডিট করতে পারেন, কিংবা ওয়ার্ডপ্রেস বা সিমিলার সিস্টেম থাকার ফলে আপনি বানিয়ে ফেলতে পারেন সহজ একটা ওয়েবসাইট যা মাসে কিছু ডলার উপার্জনের জন্য যথেষ্ট হলেও একজন ব্যবসায়ী হিসেবে আপনার জ্ঞ্যান কিন্তু একেবারেই শুন্য। আর সেখানে এই স্টাডি বা রিসার্চটা অনেকের কাছেই নতুন নাম ই বটে।

আসুন অল্প কথায় আমার ভাষায় জেনে নেই রিসার্চ জিনিস টা আসলে কি? রিসার্চ মানে ঘাঁটাঘাঁটি। অনেক ধরণের ঘাঁটাঘাঁটি ই করা হয় এখানে, কিন্তু আমি বলি ফ্রিল্যান্সিং এরটা। এখানে আপনি ঘাটবেন আপনি যা করছেন, তা আদৌ কি ডিমান্ডফুল কিনা। যা করছেন তা কি আসলেই আপ টু দ্যা মার্ক করছেন কিনা? যা করছেন তা অন্যদের কম্পিট করার মতো ষ্ট্যাণ্ডার্ড কিনা। এর পরে আসে আপনি কি করছেন আর অন্যরা কি করছেন। কার টা ভালো? সেটাকে আরও বেটার ভাবে আপনি কি উপায়ে রিপ্রেসেন্ট করতে পারেন? কোন দেশে কোন কাজের ডিমান্ড বেশি হচ্ছে! ইকনমি কোন দিকে যাচ্ছে! কোথায় কি ইভেন্ট হচ্ছে, কি কি স্পেশাল ডে আছে আগামী বছরে? জানতে হবে কোন দেশের জন্য আপনি কখন জেগে থাকবেন আর ঘুমাবেন? কিভাবে আপনার কাজ টাই আরও ইজিলি কেউ কিভাবে প্রভাইড করছে কিন্তু আপনি হয়তো পারছেন না! আপনার কাজের প্রগ্রেস হচ্ছে কিনা, নতুন কি রিলিজ হল যা আপনার অজানা। কাজের ক্ষেত্রে কি কি আপডেট এলো যা আপনি এখনো এডপ্ট করেননি ইত্যাদি। আর বুকে চিন চিন ব্যাথা করার মতো বিষয় হল এটা একটা কন্টিনিউয়াস প্রসেস যা আপনাকে সারা দিন এমন কি সারা জীবন করে যেতে হবে।

সো, এই রিসার্চ টা যদি আপনি ভালো করে করতে না পারেন, তবে আপনাকে তুলনা করা যেতে পারে একজন অন্ধ ফুটবলার এর সাথে। সেরা ফুটবলার হয়েও যদি আপনি চোখে না দেখেন, তো গোল সেটা আপনার কপালে যে জুটবেনা, তা মাইকিং করে বলে বেড়ানোর কিছু কিন্তু নেই। সবাই বুঝতে পারবে তবে এই আপনি যদি তা বুঝতে না পারেন, তবে সত্যি ভাই, আপনার মগজের চামড়া অনেক মোটা। দিমাগ কি বাত্তি জ্বালাতে হবে আর আমাদের নিজেদের সব কিছু সাথে বাকিদের সব কিছু নিয়েই করতে হবে রিসার্চ।

এটা আমাদের অভ্যাসে নেই কিন্তু ফ্রিল্যান্সিং তথা যে কোন ব্যবসায় এই জিনিসের কোন বিকল্প নেই! আর এই রিসার্চ করার জন্য আপনাকে ইন্টারন্যাশনাল রিসারচার হতে হবে না, না আপনাকে গুগল এনালাইটিক্স তথা এসিও তে করে আসতে হবে গন্ডায় গন্ডায় কোর্স (তবে দক্ষ হতে আমি দোষের কিছু কিন্তু দেখিনা একেবারেই তবে তা অবশ্যই একটা দীর্ঘ পথ যা এক দিনে পাড়ি দেয়া সম্ভব নয় কখনই)